যখন আপনি চিন্তা করবেন পৃথিবীতে এমন কি জিনিস আছে যা আপনাকে মেরে ফেলতে সক্ষম, তখন আপনি কি তার প্রতিউত্তরে কখনোই আপনার ব্যবহৃত ঐ ছোট্ট স্মার্টফোনকে কারণ হিসেবে দেখাবেন? না, কখনোই না… কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আপনার অজান্তেই ঐ স্মার্টফোনটি আপনাকে তিলে তিলে হত্যা করছে।
আমরা কিন্তু ফাইভ জি, ওয়াই-ফাই কিংবা ফোন সিগন্যাল কর্তৃক আমাদের মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কথা বলছি না। তবুও ইতোমধ্যেই শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র স্মার্টফোনের কারণেই পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
সুস্পষ্ট একটি উদাহরন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক, আমাদের রাস্তাঘাটে সচরাচর বহু মানুষ মারা গিয়েছে শুধুমাত্র এ কারণেই যে তারা ড্রাইভিং করতে থাকা স্বত্বেও বোকার মত তাদের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে! “কমিউনিটি অ্যাটিটিউডস টু রোড সেইফটি-২০১৩” জরিপের রিপোর্ট অনুসারে, মানুষ রাস্তাঘাটে ট্র্যাফিকে স্বাচ্ছন্দ্যে অনেকটা জম্বির মত হেলেদুলে চলাফেরা করে।
অ্যামেরিকায় পথচারীদের মৃত্যুর সংখ্যা ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৭ সালের হিসেব মতে, বিগত এক বছরে অস্ট্রেলিয়ায় পথচারীদের মৃত্যুহার প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিলো, আর পুলিশ এক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহারকেই প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করেছে।
কিছু সংখ্যক মানুষ যখন রাস্তায় চলাচল করে, তখন তারা চারপাশের বিরাট যানবাহন কে উপেক্ষা করে মোবাইলের ঐ ছোট্ট স্ক্রিনের মধ্যেই গুটিশুটি মেরে থাকে; আর আপনি এই পুরো ব্যাপারটি যদি রাস্তায় চলাচলের সময় পর্যবেক্ষণ করে না থাকেন তবে ধরে নিতে পারেন যে তাদের মতো আপনিও আপনার ফোনের স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে আপনি এখন হয়তো নিজেকে স্মার্টফোন পাগল ওসব মানুষদের মত না ভেবে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কিন্তু সত্যি করে বলুন, আপনার সাথে আপনার ব্যবহৃত স্মার্টফোনের মূল সম্পর্কটা কি? এটি আপনার হঠাৎ অনেক বড় কোনো ক্ষতি না করলেও আপনি কি নিশ্চিত হতে পারবেন যে এটি আপনার দেহের কোনো ক্ষতিই করছে না?
উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক, আপনি কি ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন’ নামক কোনো সিনড্রোম সম্পর্কে অবগত যা স্মার্টফোন থেকেই ছড়ায়? ধরুন, আপনার মনে হলো আপনার ফোনে তৎক্ষণাৎ একটি ম্যাসেজ আসার কারণে ফোন থেকে একটি ভাইব্রেশন হয়েছে, তারপর আপনি ফোনটি চেক করে বুঝতে পারলেন যে বাস্তবে কোনো ম্যাসেজই আসেনি! অর্থাৎ ভাইব্রেশন না হওয়া সত্যেও আপনার মনে হচ্ছে ফোনটি ভাইব্রেট করেছে।
এই অদ্ভুত এবং সংবেদনজনিত বিষয়টি ‘হাইপার ভিজিলেন্স’ এর কারণে ঘটে থাকে। কোনো সন্দেহ নেই যে মোবাইল ফোনের অধিক ব্যবহারে আপনিও একদিন এই সিনড্রোমে পড়তে পারেন, আপনি যখন প্রতিনিয়তই মানসিক চাপ নিয়ে আপনার জীবনের থেকেও বেশি মূল্যবান মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকেন, তেমনই মৃত্যুও তখন আপনার থেকে এক মিটারেরও কম দূরত্বের মধ্যে চলে আসে।
মূল বিষয়টি হল, রেগুলার স্মার্টফোন আমাদের দিনে শত শতবার ডোপামিন হরমোনের তৃপ্তি দিয়ে থাকে; আর প্রতিনিয়তই স্মার্টফোন এ হরমোনের প্রতি আমাদেরকে আসক্ত করার মাধ্যমে তার করায়ত্তে গ্রাস করে নিচ্ছে। স্মার্টফোনের কারণেই আমাদের দেহে একযোগে কর্টিসল হরমোনও ভয়ানক মাত্রায় নিঃসৃত হয়।
উক্ত হরমোন দুটি আমাদের কোনো বিষয়ে মনোযোগ সৃষ্টি থেকে শুরু করে ঘুম পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া আমাদের স্মরণশক্তি, এমনকি আত্মসম্মান বোধ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং আমাদের স্বাস্থ্যকে চরম মাত্রায় প্রভাবিত করে থাকে।
আপনারা সম্ভবত জানেন যে, মোবাইলের কিছু অ্যাপস এবং ডিভাইসটিকেও এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যা আমাদের ভিন্ন কোনো নতুন অভ্যাস তৈরির ওপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে দেওয়া লাইক গুলোও আমাদের মস্তিষ্কে কিছু ভালো লাগার ক্যামিকেল নিঃসরণ করে যেমনটা পোকার মেশিন গুলো করে থাকে, আর তাই আমাদের ঐ লাইকগুলো বারবার চেক করে দেখতে ইচ্ছে করে।
কর্টিসল হরমোন মূলত কখনো যদি আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো বার্তা আসে, তাতে সাড়া প্রদান করে থাকে। এটি তৎক্ষণাৎ শরীরের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে দেয়, শারীরিক ভাবে পরিবর্তন আনয়ন করে, অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ বন্ধ করে দেয় এবং ব্লাড সুগারকে অকেজো করে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আপনার দেহে কর্টিসল হরমোনটি তখনো রিলিজ হয় যখন আপনি মানসিকভাবে খুবই চিন্তিত থাকেন। আর আপনার অজান্তেই স্মার্টফোনও প্রতিদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় এমন মানসিক চাপ প্রদান করে যাচ্ছে।
“দি সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাডিকশন”-এর প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড গ্রিনফিল্ড বলেছেন, “আপনি আপনার ফোনটি একবার দেখলে কিংবা ফোনটি আপনার কাছাকাছি কোথাও থাকলেও আপনার দেহে কর্টিসল হরমোন রিলিজ হতে পারে, কিংবা যখন আপনি ওটার কথা চিন্তা করেন ঠিক তখনও।”
এভাবেই আপনি এমন একটি চক্রের মধ্যে যেতে থাকেন যা আপনাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রতিনিয়তই উচ্চ মাত্রায় কর্টিসল সরবরাহ করেই যায়। আর এই উচ্চ মাত্রার কর্টিসল আপনার দেহে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্ষতি ধীরে ধীরে সাধন করতে পারে; যেমন হার্ট অ্যাটাক, ডিমেনশিয়া, ডায়াবেটিস কিংবা ডিপ্রেসন।
আরও পড়ুনঃ বাথরুমে ফোন ব্যবহার: অভ্যাসটি হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ!
“হ্যাকিং অব দি আমেরিকান মাইন্ড” বইটির লেখক ডক্টর রবার্ট লাস্টিগ সম্প্রতি “দি নিউ ইয়র্ক টাইমস”-এ বিবৃতি দিয়েছেন, “আমরা জানি প্রতিটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ মানসিক চাপের সংস্পর্শে এলে আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করে এবং আপনার ব্যাবহৃত স্মার্টফোন এভাবে মানসিক চাপ প্রদানে নিত্যই অবদান রেখে চলেছে।”
স্মার্টফোনের কারণে কিশোর আসক্তি এবং উদ্বেগ
“টিন ব্রেইন” বইয়ের লেখক ডেভিড গিলেসপি এর মতে, “এটা অনেকটা তরুণদের কোকেইন বা হিরোইন দেয়ার মতোই।” লেখক তার বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে, যুবক বয়সে আমাদের যেকোনো জিনিসে আসক্তির পরিমাণ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। একারণেই বলা হয় কিশোর বয়স হলো এমন এক ভয়ানক সময় যখন মদ্যপান, ধূমপান, এমনকি সেক্স এর সূচনার করারও ইচ্ছে জাগে। তবে গিলেসপি উল্লেখ করেছেন যে বর্তমান সমাজে কিশোর বয়সিরা এমন নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপার উপলব্ধি করেছে এবং এ থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকে সফলতাও অর্জন করেছে।
“২০০৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত, কিশোরীদের গর্ভবতী হবার হার এবং পাশাপাশি কিশোরদের মদ্যপান ও ধূমপানের নেশাও প্রায় অর্ধেকটা হ্রাস পেয়েছে, এটি একটি বিশাল অর্জন এবং আমি জানিনা কেন এখন আমরা এবিষয়ে আরো বিস্তারিত কথা বলছি না,” গিলেসপি ব্যক্ত করেন। “একইভাবে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশার হারও হ্রাস পাওয়া উচিত ছিল; তার পরিবর্তে এসবের হার প্রকৃতপক্ষে তুলনামূলকভাবে আরো দ্বিগুণ হয়েছে।”
“এটি আমাদের প্রত্যক্ষভাবে জানান দিচ্ছে, কিছু একটা এই মদ্যপান কিংবা ধূমপানের আসক্তিকে প্রতিস্থাপন করেছে। আর ঐ প্রতিস্থাপিত জিনিসটি বর্তমান তরুণ সমাজের মাঝে আরো বেশি আসক্তি সৃষ্টি করছে, যা জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্রমে মানসিক অসুস্থতা বয়ে এনেছে।” গিলেসপির মতে এর মূল কারণটি হল, “স্মার্টফোন”।
কিশোর-কিশোরীরা এ বয়সে অবশ্যই অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে, তবে এক্ষেত্রে ছেলে আর মেয়েদের ভিন্নভাবে টার্গেট করা হয়েছে। গিলেসপির গবেষণা অনুযায়ী, “অল্পবয়স্ক মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যখন তারা একদল মেয়েদের মধ্যে থাকে তখন তাদের দেহে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয়। আর হরমোনের প্রভাবে তখন অল্পবয়স্ক মেয়েরা খুশি হয়, তাদের মনে হয় দলের সবাই তাকে খুব পছন্দ করেছে। আর এই সিমুলেশনটিই সোশ্যাল মিডিয়া সফটওয়্যারগুলো করে থাকে। সমস্ত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মত অ্যাপগুলো হলো সামাজিক অনুমোদন পাওয়া উচ্চ-গতির সিমুলেটর এবং আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েরা সত্যিই তাতে সাড়া দেয়।”
অন্যদিকে কিশোররা, গিলেসপির মতে ছেলেরা ঝুঁকি এবং বিপদ দ্বারাই অধিক উদ্দীপ্ত হয়। “যে কারণে বিভিন্ন সিমুলেশন গেমস এত জনপ্রিয়; এটি তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ও বিপদের মাঝে সারভাইভ করে পুরষ্কার পাওয়ার মতোই,” তিনি বলেন।
এমনকি এসব ডিভাইস আবিষ্কারের উদ্যোক্তাও এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে জানিয়েছেন।“স্টিভ জবস এর তৈরি ডিভাইসগুলোর ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে আলোচনা তার সাথের একটা ইন্টারভিউতে অনেকটা হুট করেই এসে গিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে তিনি তার বাচ্চাদের আইপ্যাড কিংবা অন্যান্য ডিভাইস দিয়ে আদৌ খেলতে দেন কিনা। স্টিভ জবস ডিভাইসগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল; আর তাই তিনি বলেন, তিনি তার বাচ্চাদের প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত এসকল ডিভাইস ব্যবহার করতে দেবেন না।
এটি কি বলার অপেক্ষা রাখে না? আপনি নিজে তৈরি করেন কিন্তু আবার ওদের ওসব কিনে দেবেন না!” গিলেসপি হেসে বলেছিলেন। “কিন্তু এটাই এসময়ে সিলিকন ভ্যালিতে ট্রেন্ড হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমান এক্সিকিউটিভরা তাদের বাচ্চাদের লালন-পালনকারীদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা বাচ্চাদের এসকল ডিভাইসের ধারে কাছেও ঘেঁষতে না দেয়।”
“এবং এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ধনী ব্যক্তিরা তাদের স্মার্টফোন বা এধরনের ডিভাইস বাচ্চাদের নিকট খুব কমই দিয়ে থাকেন, উপরন্তু তারা ডিভাইস দেওয়ার পরিবর্তে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর জন্য মানুষকে অর্থ প্রদান করতেও রাজি আছেন। তারা মনে করেন শিশুদের স্মার্টফোনের স্ক্রিন উপহার দেওয়া একটি নিম্ন-শ্রেণীর বিবেচনাবোধ।”
বিগত এক যুগ ধরে হয়ত আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে চলেছি; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এখনও আমরা প্রায় সবাই-ই এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে তেমনভাবে অবগত নই। আপনি শুধু আপনার বাচ্চার উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবটা একটু চিন্তা করে দেখুন, পাশাপাশি আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথাও ভাবুন।
বর্তমানে দশ বছরের বেশি বয়সের যেকোনো বাচ্চা স্মার্টফোনবিহীন একটা জগৎ ইতোমধ্যে কল্পনাই করতে পারছে না, আর কৈশোরে উপনীত হবার সাথে সাথেই তাদের বাবা-মা এমন ক্ষতিকর ডিভাইসটি তাদের বরাবরের মত উপহার দিয়ে আসছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন যে আসন্ন বছরগুলিতে ফাইভ জি নেটওয়ার্ক মানব স্বাস্থ্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটি স্পষ্ট, ভবিষ্যতে স্মার্টফোন বন্দুক দিয়ে মানুষের নিজের পায়ে নিজে গুলি করার মত শক্তিশালী উদাহরণ হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে।
হাসান সৈকত/ নিজস্ব প্রতিবেদক